ব্যবসায়িক চুক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ: উদ্যোক্তাদের জন্য আইনজীবীর পরামর্শ
ব্যবসায়িক চুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য সুরক্ষা ও আস্থার ভিত্তি তৈরি করে। জানুন কেন প্রতিটি ব্যবসায়িক সম্পর্কের শুরুতেই লিখিত চুক্তি জরুরি।
TEAM MITHILA
5/8/20241 min read


বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সমাজ দিন দিন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন স্টার্টআপ, ছোট ব্যবসা এবং বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান প্রতিদিনই বাজারে প্রবেশ করছে। ব্যবসার এই দ্রুত বিকাশ অবশ্যই উদ্দীপনামূলক, তবে এর সাথে জটিলতা ও ঝুঁকিও আসে। অধিকাংশ উদ্যোক্তা ব্যবসার আইনি বিষয়গুলিকে যথাযথ গুরুত্ব দেন না, বিশেষ করে ব্যবসায়িক চুক্তি (Business Contract) বিষয়টি।
অনেকে মনে করেন, চুক্তি কেবল বড় কোম্পানি বা ব্যাংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে, প্রতিটি ব্যবসা—ছোট বা বড়—চুক্তি ছাড়া ঝুঁকিতে থাকে। চুক্তিই হলো সেই আইনি সুরক্ষা, যা আপনার ব্যবসাকে নিরাপদ রাখে, ঝুঁকি কমায় এবং বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে।
ব্যবসায়িক চুক্তির মূল গুরুত্ব
১. দায়িত্ব ও অধিকার নির্ধারণ
চুক্তি হলো দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তিভিত্তিক সমঝোতা। এতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে—কার কী দায়িত্ব থাকবে, কে কোন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবে, এবং কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে কীভাবে সমাধান হবে।
উদাহরণ: ধরুন, একজন উদ্যোক্তা তার ব্যবসায়িক অংশীদারের সঙ্গে একটি জিনিসপত্র সরবরাহের চুক্তি করেছেন। চুক্তি না থাকলে পণ্য পৌঁছানোর সময়কাল বা দামের বিষয়ে বিরোধ হতে পারে। লিখিত চুক্তি থাকলে উভয় পক্ষই তাদের দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে।
২. আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে
ব্যবসায় আর্থিক ঝুঁকি সর্বদা থাকে। চুক্তি ঠিকমতো না হলে পেমেন্ট বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। একটি সুসংগঠিত চুক্তি নির্দিষ্ট করে দেয়—কতো সময়ের মধ্যে পেমেন্ট করতে হবে, যদি দেরি হয় কি জরিমানা বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
উদাহরণ: একটি স্টার্টআপ একটি প্রযুক্তি প্রোডাক্ট বিক্রি করছে এবং চুক্তি অনুযায়ী ক্লায়েন্ট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পেমেন্ট করতে বাধ্য। চুক্তি না থাকলে পেমেন্ট নিতে উদ্যোক্তার জন্য আইনি ঝুঁকি বাড়ে।
৩. বিরোধ মীমাংসা সহজ করে
যে কোনো ব্যবসায় মতবিরোধ হওয়া স্বাভাবিক। লিখিত চুক্তি থাকলে সেই বিরোধ মীমাংসা অনেক সহজ হয়। কারণ চুক্তির প্রতিটি ধারা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক এবং প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
উদাহরণ: একটি বিজ্ঞাপন সংস্থা এবং একটি ক্লায়েন্টের মধ্যে চুক্তিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকে—কোনো প্রজেক্ট সময়মতো না হলে কি জরিমানা ধার্য হবে। এতে বিরোধের সময় উভয় পক্ষের জন্য সমাধান সহজ হয়।
৪. আস্থা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি করে
লিখিত চুক্তি শুধুমাত্র আইনি সুরক্ষা নয়, এটি দুই পক্ষের মধ্যে আস্থা তৈরি করে। যখন একজন উদ্যোক্তা লিখিত চুক্তির মাধ্যমে দায়িত্ব ও শর্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে, তখন ব্যবসার অন্য পক্ষও নিশ্চিত থাকে যে সবকিছু নিয়মমাফিক হচ্ছে।
এছাড়া, পেশাদারিত্বের দিক থেকেও চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেখায় যে আপনি ব্যবসাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, আইনি দিকগুলোকে উপেক্ষা করছেন না।
৫. আইনি সুরক্ষা প্রদান করে
চুক্তি না থাকলে আইনগতভাবে দাবী প্রতিষ্ঠা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। লিখিত প্রমাণ থাকার কারণে ব্যবসায় কোনো পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে আইনের আশ্রয় নেওয়া সহজ হয়।
উদাহরণ: একটি ব্যবসায়িক লিজ চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে—প্রতি মাসে ভাড়া কত এবং চুক্তি ভঙ্গ করলে কি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চুক্তি না থাকলে ভাড়া আদায় বা লিজের শর্ত পূরণ করানো অনেক কঠিন হয়ে যায়।
উদ্যোক্তাদের জন্য আইনজীবীর পরামর্শ
নতুন ব্যবসা শুরু করার আগে বা চলমান ব্যবসায় চুক্তি করার সময় একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন আইনজীবী শুধুমাত্র চুক্তি তৈরিতে সাহায্য করেন না, বরং:
চুক্তিতে কোনো আইনি ফাঁক বা ঝুঁকি থাকলে তা সনাক্ত করেন।
ব্যবসার ধরন অনুযায়ী উপযুক্ত শর্তাবলী সাজান।
বিরোধ বা সমস্যার ক্ষেত্রে কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তার কৌশল দেন।
ব্যবসার শর্তাবলী সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় লিখতে সাহায্য করেন।
উদাহরণ: ধরুন, একজন স্টার্টআপ তার প্রযুক্তি সফটওয়্যার বিক্রির জন্য ক্লায়েন্টের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে। আইনজীবীর পরামর্শ ছাড়া, স্টার্টআপটি হয়তো পেমেন্টের সময়সীমা বা দেরির শর্ত ঠিকমতো উল্লেখ করতে পারত না। পরে সমস্যা হলে আইনি সহায়তা পাওয়া কঠিন হতো। কিন্তু অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে চুক্তি তৈরি করলে ঝুঁকি কমে যায় এবং উভয় পক্ষই নিরাপদ থাকে।
চুক্তি করার সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
লিখিত চুক্তি নিশ্চিত করুন – মৌখিক চুক্তিতে বিশ্বাস করা ঝুঁকিপূর্ণ।
স্পষ্ট ও সহজ ভাষা ব্যবহার করুন – জটিল আইনি শব্দপত্র অপ্রয়োজনীয় বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।
সমস্ত শর্ত বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করুন – দায়িত্ব, সময়সীমা, অর্থ, জরিমানা ও বিরোধ সমাধান।
আইনজীবীর পরামর্শ নিন – অভিজ্ঞ আইনজীবী আপনার ব্যবসার জন্য সেরা ও নিরাপদ চুক্তি প্রস্তুত করবেন।
স্বাক্ষরের আগে ভালোভাবে পড়ুন – প্রতিটি ধারা বুঝে নিন এবং প্রয়োজনে ব্যাখ্যা চাইুন।
বাস্তব উদাহরণ
ধরা যাক, রাহুল একটি ছোট প্রযুক্তি স্টার্টআপ শুরু করেছেন। তিনি একজন সরবরাহকারী কোম্পানির সঙ্গে মৌখিক চুক্তি করেছেন, কিন্তু লিখিত চুক্তি করেননি। পরে সরবরাহকারী পণ্য সময়মতো সরবরাহ করতে ব্যর্থ হন। এই পরিস্থিতিতে রাহুল আইনি পদক্ষেপ নিতে চাইলেও কোনো প্রমাণ না থাকায় তাকে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়।
অপরদিকে, সোনালী একজন উদ্যোক্তা, যিনি তার সকল চুক্তি আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত করেছেন। একই ধরনের সমস্যা হলেও তার ক্ষেত্রে চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহকারীকে জরিমানা দিতে হয়েছে এবং ব্যবসা ক্ষতি ছাড়াই চালু রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
এ উদাহরণই স্পষ্টভাবে দেখায়—কেন চুক্তি এবং আইনজীবীর পরামর্শ গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যবসায়িক চুক্তি হলো শুধু আইনি ডকুমেন্ট নয়; এটি ব্যবসার সুরক্ষা, আস্থা এবং পেশাদারিত্বের প্রতীক। উদ্যোক্তাদের উচিত প্রতিটি ব্যবসায়িক লেনদেনের শুরুতেই চুক্তি করা, এবং প্রয়োজনে অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া। এতে ঝুঁকি কমে, ব্যবসা নিরাপদ হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসার জন্য সুনিশ্চিত ভিত্তি তৈরি হয়।
আপনি কি আপনার ব্যবসার জন্য চুক্তি করতে যাচ্ছেন? অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি না নিয়ে আজই অভিজ্ঞ আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করুন।